মলয় সাহা : দ্বারকা সাম্রাজ্যের নিরালায় ভালকা–র এক নির্জন জঙ্গলে পা ঝুলিয়ে বসলেন শ্রীকৃষ্ণ। ত্রিভুবনের অধিপতি তিনি। অজ্ঞাত নয় তাঁর কোনওকিছুই। তিনি জানেন, একটু পরেই ছিলা থেকে ছুটে আসবে এক বিষাক্ত তীর। যে তীর দ্বারকাধীশের পার্থিব লীলায় যবনিকা ফেলবে। কান্নায় ভাসাবে কৃষ্ণভক্তকূলকে।
হলও তাই। জরা নামে ব্যাধ যদু বংশ ধ্বংসকারী মুষল অবশিষ্ট লোহার ফলা দিয়ে গড়ে নিয়েছিল একটি তীর। পশু শিকারে সিদ্ধহস্ত জরা দূর থেকে ভেবেছিল, কোনও বড়সড় পাখি রয়েছে গাছের ওপর। তারপর অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ। যন্ত্রনায় আর্তনাদ করে উঠলেন দেবকীনন্দন। কংসের কারাগার দিয়ে যার মর্ত্যলীলার শুরু, তামাম রাক্ষসকূল যার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারে নি, কুরুক্ষেত্রের ভয়াবহতা যার অঙ্গুলিহেলনে শেষ হয়েছে, সেই মধুসূদন কিনা এক অখ্যাত ব্যাধের শরে শরীর ছেড়ে দেবেন ? জড়া হাউ হাউ করে কাঁদল। লুটিয়ে পড়ল বিশ্বপিতার রক্তার্ত পায়ের ওপর। এ কী করলাম প্রভু ? এ আমি কী করলাম ? যন্ত্রনার ওপর মৃদু হাসির প্রলেপ দিলেন ভগবান, তোমার কোনও দোষ নেই জড়া। সবটাই যে হয়েছে আমারই নির্দেশে। আমিই ঠিক করেছিলাম, তুমিই হবে সেই পুরুষ, যে আমার দ্বাপর লীলাশেষের কান্ডারী হবে। আবার সে–ই হবে আমার কলিযুগ আলো করার পুরুষোত্তম লীলার দিশারী !
জরা চোখ মোছে। জানতে চায়, কী করব প্রভূ ? আমি যে মহাপাতক ! আমাকে শাস্তি দিন প্রাণনাথ !শাস্তি দিলেন না দীনবন্ধু। দিলেন আদেশ, জড়া, চলে যাও নীলাচলে। আমার পার্থিব দেহ ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার পর আমার নাভিকুন্ড সাগরে ভাসিয়ে দেবে অর্জুন। সেই নাভিকুন্ডই একদিন পৌঁছে যাবে নীলাচলে। তুমি সাগরতটে গিয়ে অপেক্ষা কর। সেখানেই আমি আবির্ভূত হব 'নীলমাধব' নামে।
ভগ্নহৃদয় জরা দৌড় শুরু করল। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যুগ কেটে গেল তপস্যায়।
তারপর একদিন দেখা মিলল সেই পরম অপার্থিব বস্তুর। লাখো সুর্যের জ্যোতি, কোটি চাঁদের দীপ্তি–ভূষিত সেই বস্তুকে ঘিরে প্রকট হলেন নীলমাধব। সাগরতীরে এক গহীন জঙ্গলে জরা শবর গোপনে শুরু করল নীলমাধবের আরাধনা।
এক রাতে ওড়িশার রাজা অনন্ত বর্মন স্বপ্ন দেখলেন, দেবতা নীলমাধব চান, তাঁর মন্দির তৈরি হোক। সাধারণ মানুষ সেই দেবতাকে দর্শন করে জীবন ধন্য করুক !
স্বপ্ন ভেঙে যেতেই রাজা উতলা হয়ে পড়লেন। কোথায় আছেন স্বপ্নের সেই নীলমাধব ? যেভাবেই হোক খুঁজে আনতেই হবে ! বিভিন্ন দলে লোক লস্কর পাঠালেন রাজা। এক ব্রাহ্মন বিদ্যাপতিও রাজার অনুমতি নিয়ে নীলনাধবকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল।বছরের পর বছর ঘুরে সব দল প্রাসাদে ফিরে এল। শুধু বিদ্যাপতি ফিরল না। সে পথ হারিয়েছিল জঙ্গলে। তারপর এক ব্যাধের বাড়িরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্যাধের পরমাসুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়। তাকে বিয়ে করে বিদ্যাপতি। প্রতি রাতে বিদ্যাপতি লক্ষ্য করে, তাঁর শ্বশুর যেন কোথায় যায় ! স্ত্রীকে কথাটা বলতেই সে চমকে ওঠে। খবরদার, জানতে চেওনা ওকথা। নইলে বাবা তোমাকে খুনও করতে পারে। কিন্তু বিদ্যাপতি নাছোড়বান্দা। অগত্যা মেয়ের কথায় ব্যাধ রাজি হয়। বিদ্যাপতির চোখ বেঁধে তাকে রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে নিয়ে যায় ব্যাধ। সবশেষে দুর্লভ দর্শন হয় নীলমাধবের। বিদ্যাপতি পরমানন্দে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
এর কিছুদিন পর রাজার কাছে ফেরে বিদ্যাপতি। নীলমাধবের সম্পর্কে সবকিছু জানায়।
আপ্লুত রাজা শোভাযাত্রা করে বেরিয়ে পড়েন বিদ্যাপতিকে সঙ্গে করে। রাজবাহিনী সেখানে পৌঁছেও যায় !
কিন্তু কোথায় কী ?
স্বপ্নের নীলমাধব সেখান থেকেই উধাও।
রাজা রেগে যান বিদ্যাপতির ওপর,
খুন করব তোমাকে ?
সে মুহূর্তেই আকাশবানী হয়, 'রাজা, নীলমাধবের ঐশ্বর্য রূপ মানুষ সহ্য করতে পারবে না। তাই আমি আসছি এই নীলাচলেই, অচল ব্রক্ষ্ম জগন্নাথ হয়ে !
তোমার তৈরি মন্দিরেই আমার দাদা বলরাম, বোন সুভদ্রা ও আমার দারুবিগ্রহ গড়ে দেবেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা !'
দেবশিল্পীর হাতে গড়া সেই তিন বিগ্রহই আজ পথে নামবেন রথে চড়ে। ভক্তরা আওয়াজ তুলবে, জয় জগন্নাথ স্বামী ! নয়ন পথগামী !
অপূর্ব লেখা।ভীষণ ভালো লেগেছে।
উত্তরমুছুন