দেবাশীষ গোস্বামী : ভারত বিখ্যাত শতাব্দী প্রাচীন কলকাতার ইস্টবেঙ্গল ক্লাব এই মুহূর্তে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। ভারতবর্ষের যতগুলি পুরনো ক্লাব আছে, তার মধ্যে ইস্টবেঙ্গল অবশ্যই অন্যতম। এই ক্লাবটি মূলত ফুটবলের জন্যই বিখ্যাত। যদিও তাদের অন্যান্য খেলার দলও আছে। এবারের এই সমস্যাটি কথা বলতে গেলে আমাদের একটু পিছনের দিকে তাকাতে হবে।
এই ক্লাবটির জন্ম ১৯২০ সালের ১ আগস্ট। দু'বছর আগে ধুমধাম করে শতবর্ষ পালিত হয়েছে। জন্মের পর থেকেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। আগে এইসব ক্লাবগুলি সারা বছরের খরচ মূলত সদস্য চাঁদা ও কিছু নামিদামি মানুষের অনুদান থেকে চলতো। কিন্তু ধীরে ধীরে এমন একটা সময় আসে যখন শুধুমাত্র সদস্য চাঁদা বা সামান্য কিছু অনুদান নিয়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মতো একটা বিরাট প্রতিষ্ঠান চালানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। কালের নিয়মে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবও অন্য উপায়ে অর্থ সংগ্রহের দিকে ঝোঁকে। ১৯৮৪ সালে তারা কলকাতার প্রথম বিখ্যাত কোম্পানি খাদিমকে স্পনসর হিসাবে পায়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানি ইস্টবেঙ্গলকে স্পনসর করে।
১৯৯৮ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব বিজয় মালিয়ার ইউনাইটেড গ্রুপ এর হাত ধরে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয় এবং নাম হয় ইউনাইটেড ইস্টবেঙ্গল ফুটবল টিম প্রাইভেট লিমিটেড। ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ জার্সিতে কিং ফিশারের নাম ও লোগো ব্যবহৃত হতে থাকে। এইরকমভাবে চলতে থাকে ২০১৮ পর্যন্ত। তারপর জুলাই ২০১৮ তে ব্যাঙ্গালোরের একটি কোম্পানি কোয়েস এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তৈরি হয় কোয়েস ইস্টবেঙ্গল ফুটবল ক্লাব। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জুলাই ২০২০ তে এদের সঙ্গে সম্পর্কের অবসান ঘটে। পরবর্তীতে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ভালো বিনিয়োগকারীর সন্ধান করতে থাকে। কিন্তু তারা পেরে ওঠেনি। সেই সময়ও তারা খুব সমস্যার মধ্যে পড়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। তাঁর উদ্যোগে ২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে শ্রী সিমেন্ট কোম্পানি একটি প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন এস সি ইস্টবেঙ্গল নামে আত্মপ্রকাশ ঘটে।পরবর্তীতে তারা তড়িঘড়ি করে নিজেদের নাম আইএসএলে নথিভূক্ত করতে সমর্থ হয়। বিখ্যাত কোচ রবি ফাউলারকে সামনে রেখে টিম তৈরি করে। খুব অল্পসময়ের মধ্যে গড়া এই দল ২০২০ সালের আইএসএলে খুব ভালো ফল করতে পারেনি। মোট এগারোটা দলের মধ্যে নবম স্থান অধিকার করে।
এই বছরের অর্থাৎ ২০২১ এর শুরু থেকেই শুরু হয় মূল সমস্যা। কারণ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে যে নতুন কোম্পানিটি গাঁটছড়া বেঁধেছে, সেই শ্রী সিমেন্ট এর পক্ষ থেকে ক্লাবকে নতুন করে পূর্ণাঙ্গ চুক্তি করার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের বর্তমান কর্মসমিতি সেই চুক্তিপত্রের কিছু পরিবর্তনের কথা বলে। বিনিয়োগকারী সংস্থা শ্রী সিমেন্ট তাদের প্রেরিত চুক্তিপত্রেই সই করার জন্য অনড় থাকে। শেষে গত ১৬ জুলাই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মসমিতির বৈঠক করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায় যে, কোনওমতেই এই চুক্তিপত্রে সই করা সম্ভব নয়। এই ৩১ জুলাই এর মধ্যে যদি দল গঠন করা না হয়, তাহলে ২০২১-২২ বছরে কোনও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে না। গত বছর দলের বেশীরভাগ নামি খেলোয়াড় পুনরায় চুক্তিবদ্ধ না হওয়ার কারণে ইতিমধ্যে তাঁরা অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। এরপর ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থকরা চুক্তিপত্রটি জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু কর্তারা চুক্তিপত্রটি খতিয়ে দেখার জন্য প্রাক্তন খেলোয়াড়দের ক্লাবে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।ভাবতেও অবাক লাগে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মতো ঐতিহ্যবাহী দল, যে দলের দখলে এখনও পর্যন্ত তিনবার আই লিগ, আটবার ফেডারেশন কাপ, তিনবার সুপার কাপ, ২৯ বার আইএফএ শিল্ড, ১৬ বার ডুরান্ড কাপ ছাড়াও আরও অনেক বড় বড় প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। সেই ক্লাবে আজকের এই অবস্থার মধ্যে পড়ার জন্য ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের লাখো লাখো সমর্থক খুবই মুষড়ে পড়েছেন। সকলেই আশা করছেন, এই অবস্থায় আবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করবেন এবং আবারও ক্লাবকে সংকটমুক্ত করবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন