সমকালীন প্রতিবেদন : কেন্দ্রীয় মৎস্য শিক্ষা সংস্থানের (কলকাতা) মুখ্য বিজ্ঞানী ড. বিজয়কালী মহাপাত্র বলছেন, 'গোটা বিশ্বে এই মুহূর্তে বছরে ৪৫০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থের ব্যবসা চলছে রঙিন মাছকে ঘিরে। যার মধ্যে ৮৫ শতাংশ আয় হচ্ছে মিষ্টি জলের মাছ থেকে। বাকি ১৫ শতাংশ সামুদ্রিক মাছের ব্যবসা। শুধুমাত্র ভারতেই ৩৭৪ ধরনের মিষ্টি জলের রঙিন মাছের ব্যবসা হয়। যেখানে নোনা জলের রঙিন মাছের সংখ্যাটা প্রায় সাতশো।' আঠারো শতকে ইউরোপে প্রথম গোল্ডফিশের দেখা মিললেও চীনারাই এই মাছটির কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য পায় বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ তো গেল মাছের কথা। আর অ্যাকোয়ারিয়াম! সেও এক রোমাঞ্চ। ১৮০০ শতকে কাচের আবদ্ধ পাত্রে সামুদ্রিক জীব সংরক্ষণের ধারণাটি প্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেসময় এই ধরনের পাত্রকে বলা হতো ওয়ার্ডিয়ান ট্যাঙ্ক। কারণ, এটি যাঁর মস্তিস্কপ্রসূত তাঁর নাম ড. ন্যাথানিয়েল ওয়ার্ড। এর পর সামুদ্রিক অ্যাকোরিয়াম তৈরি করে রীতিমতো হইচই ফেলে দেন অ্যানাথাইন। তিন বছরেরও বেশি সময় তিনি কাচের পাত্রে সাগরের নোনা জলে পাথুরে প্রবাল আর সামুদ্রিক শৈবাল বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ওই সময়েই রবার্ট ওয়ারিংটন তৈরি করে ফেলেছেন ১৩ গ্যালনের একটি পাত্র। তাতে তিনি গোল্ডফিশ, শামুক সহ কয়েকটি প্রাণী রেখে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান। ১৮৫১ সালে ইংল্যান্ডে অ্যাকোয়ারিয়ামের জনপ্রিয়তা অনেকটা বৃদ্ধি পায়। আর এর পিছনে যাঁর অবদান, তিনি হলেন ফিলিপ হেনরি গসে। তিনিই প্রথম মাছ আর গাছপালা ভর্তি কাচের পাত্রের নাম দেন অ্যাকুয়াটিক ভিভ্যারিয়াম। যা পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত হয়ে অ্যাকোয়ারিয়াম।
রঙিন মাছ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চালানো বিজয়বাবুর দাবি, ভারতের সবচেয়ে পুরনো পাবলিক অ্যাকোয়ারিয়ামটি তৈরি হয় ১৯৫১ সালে। সেটি হল মহারাষ্ট্রের তারাপোরেওয়ালা অ্যাকোয়ারিয়াম। ২০০৭ সালে জম্মুতে তৈরি হয় আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাকোয়ারিয়াম, যা কি না ছিল এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড়। জম্মুর বাঘে বহু উদ্যানে তৈরি হয় ওই অ্যাকোয়ারিয়াম। ২০১০ সালে লখনউয়ের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ফিশ জেনেটিক রিসার্চে তৈরি হয় আরও একটি অ্যাকোয়ারিয়াম। যেখানে ঠাঁই পায় বহু ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছ।
সালটা ১৮৫৩। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় লন্ডন চিড়িয়াখানায় তৈরি হয় ফিশ হাউজ বা মাছের ঘর। প্রদর্শিত হয় সেটি। যা দেখে অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরির নেশা বেড়ে যায় অনেকটাই। অনেকেই নিজের মতো করে চেষ্টা করতে থাকেন। সেসময় যে ধরনের অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরি হচ্ছে, তাতে মাছ রাখলে কিছুদিনের মধ্যেই নোংরা হয়ে যাচ্ছে জল। মাছ মারা যাচ্ছে। আবার জল পরিষ্কার করাও সমস্যার। এইসময় এডওয়ার্ডস নামক এক প্রাণীবিদ এমন একটি অ্যাকোয়ারিয়াম সামনে আনলেন, যাতে জল ছেঁকে পরিষ্কার হয়ে নীচের একটি পাত্রে পড়বে। ফলে ঝামেলা অনেকটাই কমল। তখন অবশ্য বেশিরভাগ অ্যাকোয়ারিয়ামের গঠন একইরকম ছিল। তিনদিকে কাঠের ফ্রেম। সামনে কাচ। জলের হাত থেকে বাঁচাতে কাঠের উপর পিচের প্রলেপ দেওয়া হতো। অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশ তৈরি হতো স্লেট দিয়ে।
অ্যাকোয়ারিয়ামে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগল ঊনিশের দশকে। ১৯০৮ সালে অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহারের জন্য তৈরি হল এয়ার পাম্প। তবে তা ছিল যান্ত্রিক। এটি চালাতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হতো না। জলের বেগকে কাজে লাগিয়ে চলত সেটি। অনেক পরে বিদ্যুতচালিত পাম্প এসেছে। অ্যাকোয়ারিয়ামের লোহার ফ্রেম মরচে ধরে নষ্ট হয়ে যেত। এই সমস্যার সমাধান করলেন লস এঞ্জেলেসের বাসিন্দা মার্টিন হরোউইটজ। সিলিকনের আঠা দিয়ে কাচের মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরি করলেন তিনি। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল কাজ। লন্ডনের ফিশ হাউসের জায়গা বদল হল। দর্শকদের মন ভরাতে তৈরি হল আরও বড় অ্যাকোয়ারিয়াম। যার উদ্বোধন হয় ১৯২৪ সালে।শখের অ্যাকোয়ারিয়াম নিয়ে তো অনেক কথা হল। কিন্তু মাছ দেখার জন্য পৃথিবীজুড়ে কত ধরনের অ্যাকোয়ারিয়াম যে রয়েছে, তা কি জানা আছে! অবাক করাই বটে। কোনও অ্যাকোয়ারিয়াম সমুদ্রের তলায়। তার ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। কোথাও আবার অ্যাকোয়ারিয়ামের ভিতরেই থাকার বন্দোবস্ত। টিকিট কেটে অ্যাকোয়ারিয়াম দেখার ব্যবস্থা রয়েছে দুবাইয়ে। রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার ইউশাকা ম্যারিন ওয়ার্ল্ড, চীনের সাংহাই ওশান অ্যাকোয়ারিয়াম, ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরি বে অ্যাকোয়ারিয়াম আরও কত কী। তবে জর্জিয়ার অ্যাকোয়ারিয়ামটি এদের মধ্যে বড়। আটলান্টার এই অ্যাকোয়ারিয়ামটি এক লক্ষের বেশি সামুদ্রিক প্রাণীর আবাসস্থল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন